Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-- ৭৪

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৭৪

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল – ৭৪
লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, কামারদা (খেজুরি থানা, মেদিনীপুর)
চিন্ময় দাশ

মাইতি পদবীর একটি মাহিষ্য পরিবারের আদি বসত ছিল মেদিনীপুর জেলার ভগবানপুর থানায়। একসময় সেই পরিবারের যুধিষ্ঠির, দ্বারিকানাথ এবং গয়ারাম– তিন সহোদর ভাই জীবিকার খোঁজে পৈতৃক ভিটে ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথমে নন্দীগ্রাম থানার খড়িগেড়িয়াতে গিয়ে ওঠেন। অনুসন্ধানের সময়, ওডিশা কোস্ট ক্যানেল এবং তার কাছাকাছি জলাভূমি ও বনজঙ্গলে ভরা একটি এলাকা দেখে ভারী পছন্দ হয়। খড়িগেড়িয়া ছেড়ে, কেওড়ামাল (ওরফে ইড়িঞ্চি) পরগণার কামারদা গ্রামে গিয়ে বসবাস শুরু করেন তিন জনে।
সরকারের দপ্তর খাসমহল ছিল হেঁড়িয়াতে। সেখান থেকে জঙ্গলের ইজারা নিলেন তাঁরা। সেই ইজারা থেকেই তাঁদের সঙ্গতি গড়ে উঠবার সূচনা।

 

 

তখন সদ্য কাটা হয়েছে কোস্ট ক্যানেলটি। সেপথে উত্তরমুখে গিয়ে রূপনারায়ণ বেয়ে, গঙ্গায় পড়া যায়। তারপর কলকাতা। বিশাল বাজার সেখানে। দক্ষিণমুখে এগোলে, ওডিশা রাজ্য, সমুদ্র বন্দর, কত কিছু। কাঠের চালানী ব্যবসায় নামলেন তিন ভাই। লক্ষ্মী চিরকাল হাত রাখেন উদ্যমীদের মাথায়। তাঁদেরও বিপুল অর্থাগম হতে লাগল ব্যবসা থেকে।
কিন্তু কে না জানে, লক্ষ্মী চিরকালই চঞ্চলা। সম্পদকে সম্পত্তি না করলে, বেঁধে রাখা যাবে না দেবীকে। ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’-এর সুবাদে, একটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করলেন তিনভাই। কামারদা, ঠাকুরচক, বাড় দেউলপোতা, মালদা, দেখালি, গোলাবাড়ি, কৃষ্ণনগর, পাহাড়পুর ইত্যাদি মৌজা ছিল তাঁদের মহালের ভিতর। সম্পদ ছিলই, এবার জমিদারী গড়ে, সামাজিক মর্যাদা বাড়ল মাইতি বংশের।


শৈব-রীতিতে পূজা-আচ্চা প্রচলিত ছিল তাঁদের পরিবারে। জমিদারি গড়ে, একটি শিবমন্দিরও প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু জেলা জুড়ে তখন বৈষ্ণবীয় রীতিতে দেবারাধনার প্রবল স্রোত বয়ে চলেছে। তিন ভাই সেই পথের পথিক হলেন। বিষ্ণুকে আশ্রয় করলেন। বড়সড় মাপের একটি মন্দির নির্মাণ করে, কুলদেবতা হিসাবে ‘লক্ষ্মীজনার্দন’ নামের শালগ্রাম প্রতিষ্ঠা করলেন জাঁকজমকের সাথে। মাইতি বংশের কুলপঞ্জিকা এবং মন্দিরের স্থাপত্য বিচার করে, অনুমান হয়, ইং ১৮৫০-এর সামান্য আগে-পরে কোনও বছরে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল।


তারপর দিন গিয়েছে। তিন ভাই গত হয়েছেন। পরিবার বড় হয়েছে। উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে জমিদারীও। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আড়ম্বরের সাথে দুর্গাপূজা হয়। বড় মাপের একটি দূর্গা দালান ছিল সেজন্য। জমিদারী না থাকায়, কালের আঘাত থেকে বাঁচানো যায়নি সেটিকে। বর্তমানে একটি ‘সেবাইত কমিটি’ এবং একজন ‘ম্যানেজিং সেবাইত’ নির্ধারণ করে, কুলদেবতার সেবাপূজার ধারাটি বহাল রাখা হয়েছে কোনও রকমে। তবে এত বড় মন্দিরের সংস্কার কিংবা উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ সঠিকভাবে করা যায় না।


আমরা এবার মন্দিরের প্রসংগে যাই। দীর্ঘ সাড়ে চারশ’ বছর কলিঙ্গ নৃপতিদের শাসনে ছিল মেদিনীপুরের সিংহভাগ এলাকা। সেকারণে এই জেলার মন্দির স্থাপত্য যে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, পূর্বের জার্নালগুলিতে একাধিক বার একথা উল্লেখ করেছি আমরা। বিশেষত জেলার দক্ষিণের মন্দিরগুলিতে সেই প্রভাব সর্বাধিক। কলিঙ্গ ধারায় শিখর দেউল রীতিতে বহু মন্দির নির্মিত হয়েছিল দক্ষিণ এলাকায়।
একটি আদর্শ শিখর মন্দিরে ৫টি সৌধ থাকে। সামনের দিক থেকে সেগুলি হল– নাটমন্দির, ভোগমন্ডপ, জগমোহন, অন্তরাল এবং বিমান বা মূল মন্দির। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংক্ষিপ্ত আকারে শিখর মন্দির নির্মিত হয়ে থাকে। কামারদা গ্রামের এই মন্দিরটিও শিখর দেউল রীতিতে নির্মিত হয়েছে। তবে, জগমোহন, অন্তরাল এবং বিমান–পিছনের ৩টি অংশ নিয়েই নির্মিত হয়েছে মন্দিরটি।


rethমন্দিরসৌধের প্রধান ৪টি অংশ — পাদপীঠ (ভিত্তিবেদী), বাঢ় (পাদপীঠ থেকে গর্ভগৃহের দ্বারপথের মাথার উপর পর্যন্ত), গন্ডী (মন্দিরের ছাউনি অংশ) এবং শীর্ষক (চূড়া)। এখানে দেখা যায়, এখনও আড়াই ফুটের বেশি উচ্চতা আছে মন্দিরের পাদপীঠের। তার উপর পূর্বমুখী ইটের তৈরী মন্দিরটি স্থাপিত। একটি প্রশস্ত প্রদক্ষিণ-পথ আছে মন্দিরকে বেষ্টন করে। অতীতের এক ভূমিকম্পে পাদপীঠ এবং প্রদক্ষিণ-পথটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আছে।
আলোচ্চ এই মন্দিরের জগমোহন এবং বিমান দুটি সৌধই শিখর রীতির। দুটিই বর্গাকার সৌধ– দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ১৩ ফুট এবং ১১ ফুট হিসাবে। উচ্চতায় জগমোহন ৪০ ফুট, বিমান ৪৫ ফুট। দুটিতেই রথবিন্যাস করা। বিমানে সপ্তরথ এবং জগমোহনে পঞ্চরথ বিন্যাস।

শিখর মন্দিরে কলিঙ্গধারায় ‘বন্ধন’ অংশ দেখা যায়। এই মন্দিরে বাঢ় এবং গন্ডীর বিভাজক ‘বরণ্ড’ অংশটি নির্মিত হয়নি। তবে, বিমানে ৭টি এবং জগমোহনে ৬টি ‘বন্ধন’ রচনা করে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে মন্দিরে। ছবিতে গন্ডী অংশের নীচের কিছুটা জুড়ে যে পীঢ়বিন্যাস দেখা যাচ্ছে, সেটি কোনও এক সময় সংস্কার কাজের ফল।
মন্দিরের শীর্ষক বা চূড়াটি বেশ সুরচিত ছিল– বেঁকি, বড় আকারের আমলক, ঘন্টা, কলস, সুদর্শন দিয়ে সাজানো হয়েছিল এটিকে।
অলংকরণে তেমন জোর দেওয়া হয়নি এখানে। ১. টেরাকোটার অনেকগুলি বড় আকারের চক্র দিয়ে সাজানো হয়েছে দুটি সৌধের বাঢ় অংশকে। ২. মন্দিরের পিছনের, অর্থাৎ পশ্চিমের, দেওয়ালে অতি সাধারণ মানের কয়েকটি মিথুন-ফলক আছে। ৩. দুটি দ্বারপাল মূর্তি আছে। গর্ভগৃহের দু’পাশে রচিত হয়েছে সে দুটি। মন্দিরে অন্য কোনও অলংকরণ নাই।

মন্দিরটি ভারী জীর্ণ। সংস্কার করা সেবাইত পরিবারের সাধ্যে কুলোবে, মনে হয় না। স্থানীয় প্রশাসন এবং খেজুরীর শিল্প ও ঐতিহ্যপ্রেমীরা উদ্যোগ নিলে, পুরাকীর্তিটি রক্ষিত হতে পারে।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী পরিমল কুমার মাইতি, শক্তিপদ মাইতি, দিলীপ কুমার মাইতি, প্রসেনজিৎ মাইতি– কামারদা।
সুদর্শন সেন, আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষক– পাঁচুড়িয়া, খেজুরী।
যাওয়া – আসা : ৬ নং জাতীয় সড়কের কোলাঘাট মোড়, কিংবা হাওড়া-খড়গপুর রেলপথের মেচেদা ষ্টেশন থেকে দিঘাগামী পথে হেঁড়িয়া। যে কোনো দিক থেকে ট্রেনে পাঁশকুড়া হয়েও হেঁড়িয়া পৌঁছানো যাবে। সেখান থেকে পূর্বমুখে বোগা গামী পথে ১১ কিমি দূরে কামারদা গ্রাম।

RELATED ARTICLES

Most Popular