Homeসাহিত্যজীর্ণ মন্দিরের জার্নালজীর্ণ মন্দিরের জার্নাল-- ৭৮

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল– ৭৮

জীর্ণ মন্দিরের জার্নাল – ৭৮
মহাপ্রভু মন্দির, বাসুদেবপুর (থানা– দাসপুর, মেদিনীপুর)
চিন্ময় দাশ

দাসপুর থানার বাসুদেবপুর গ্রাম। সেখানেই দু’শ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি মহাপ্রভু মন্দির। কিন্তু কে প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন এই মন্দির? এই একটি প্রশ্নের তিন-তিনটি উত্তর পাওয়া যায়। ১. মন্দিরের সেবাইত পরিবার দাবি করেন– জনৈক শুকদেব গোস্বামী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর বংশধরগণই আজও মন্দির এবং সেবাপূজার অধিকারী। ২. প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ প্রণব রায় (ঘটনাক্রমে আদিতে তিনি বাসুদেবপুর গ্রামেরই অধিবাসী) তাঁর বিবরণে বলেছেন– গুরু রায় মহাশয়, কাশীরাম ঠাকুর এবং শুকদেব ঠাকুর– এই তিনজন যৌথভাবে মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা। ৩. আর একটি উত্তর পাওয়া যায় মন্দিরের প্রতিষ্ঠা=ফলক থেকে। রীতি অনুসারে, এমন ‘পাথুরে প্রমাণ’ অস্বীকার করবার উপায় নাই।
বানান বা যতিচিহ্ন সংশোধন না করে, ফলকটির বয়ান এরকম– ” সুভমস্তু সকাব্দা ১৭৫৫ / সন ১২৪০ সাল ২৫ আসাড় / শ্রীশ্রী গুরুরায় মহাসয় / শ্রীশ্রী কাশীরাম ঠাকুর / শ্রীশ্রী শুকদেব ঠাকুর / শ্রীশ্রী মহিম দাষ / ঠাকুর “। অর্থাৎ, প্রণব রায়ের বিবরণের সাথে প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে ‘মহিম দাস ঠাকুর নামটিও যুক্ত হবে।
ফলক অনুসারে, ১৭৫৫ শকাব্দে, বাংলা ১২৪০ সনে, বা ইং ১৮৩৩ সালে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। সেই হিসাবে, বর্তমানে মন্দিরের আয়ুষ্কাল ১৮৭ বছর। তবে বর্তমানে দেখা যায়, শুকদেব গোস্বামীর বংশই মন্দিরের সেবাইত এবং পরিচালক হিসাবে বহাল আছেন।
শুকদেব গোস্বামী বাসুদেবপুর বা মেদিনীপুর জেলারও আদি বাসিন্দা নন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল হুগলি জেলার তেহরি বসন্তিপুর গ্রামে। শুকদেবের পিতা ছিলেন ‘সংসারে এক সন্ন্যাসী’। গৃহী হয়েও সর্বক্ষণ ঈশ্বরচিন্তা এবং সাধন ভজন নিয়েই সময়পাত করতেন। মেদিনীপুর জেলা মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের পদধূলি-ধন্য। সেই পবিত্রমাটির টানে পৈতৃক ভিতের টান কাটিয়ে, পরিবার নিয়ে মেদিনীপুরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিলেন। রূপনারায়ণ পার হয়ে এসে উঠেছিলেন দাসপুর থানায়। সেখানেই বাসুদেবপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন।
শুকদেবও তাঁর পিতার অনুসারী হয়েছিলেন। বৈষ্ণবীয় রীতিতে ধর্মাচরণ এবং দেবতার সেবাপূজা করতেন। বর্তমান মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে একটি লোকশ্রুতি শোনা যায়। বাসুদেবপুরের অনতিদূরে ‘দশনামী’ নামের একটি নিকাশি খাল অবস্থিত। একবার খালে জোয়ারের জলে একটি কাঠের গুঁড়ি ভেসে এসেছিল। সেদিনই শুকদেব দেবতার স্বপ্নাদেশে জানতে পারেন, গুঁড়িটি ছিল নিমকাঠের।
নিম অতি পবিত্র কাঠ। এবং স্বপ্নে সেই কাঠের পরিচয় পাওয়া আরও সৌভাগ্যপূর্ণ ঘটনা। শুকদেব তৎপর হয়ে, সেই গুঁড়ি খোদাই করে মহাপ্রভুর প্রমাণ আকারের একটি মূর্তি নির্মাণ করান । বড় মাপের একটি মন্দির নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠা করেন মহাপ্রভুর বিগ্রহটিকে। নিত্যপূজা ছাড়াও, জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী, দোল পূর্ণিমা, রাস পূর্ণিমা এবং বুদ্ধ পূর্ণিমাতে বড় আকারের উৎসবের প্রচলন করা হয় দেবতার জন্য।
আড়ে-বহরে ১২ ফুট বিস্তার এই দেবালয়টির। মাথায় ৪৫ ফুট উঁচু। ইটের তৈরি আর দক্ষিণমুখী এমনই বর্গাকার মন্দির এটি। মাঝারি মাপের উঁচু পাদপীঠের উপর মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছে ‘নব-রত্ন’ রীতিতে। পাদপীঠের উপর একটি প্রদক্ষিণ-পথ আছে মন্দিরকে বেষ্টন করে। সেই পথে গর্ভগৃহের দেবতাকে পরিক্রমা করেন ভক্তজনেরা।
দুটি অংশ এই মন্দিরের– সামনে অলিন্দ, পিছনে গর্ভগৃহ। খিলান-রীতির তিনটি দ্বারপথ এই আয়তাকার অলিন্দের। দরুণ-রীতির থামের সাহায্যে দ্বারগুলি রচিত হয়েছে। দ্বিতলে সামনে তিন-খিলানি দ্বারপথের অলিন্দ ছাড়াও, বাকি তিনদিকে তিনটি ‘আবৃত-অলিন্দ’ গর্ভগৃহকে বেষ্টন করে আছে। টানা-খিলানের সিলিং গড়া হয়েছে অলিন্দের মাথায়। ভিতরের গর্ভগৃহটিও আয়তাকার। তার মাথায় সিলিং গড়া হয়েছে বেশ মুন্সিয়ানার সাথে। প্রথমে দু’দিকে দুটি বড় আকারের খিলান। তার উপরে অন্য দু’দিকে দুটি ছোট আকারের খিলান। এর পর চারটি খিলানের মাথায় গম্বুজ স্থাপন করে সিলিং হয়েছে গর্ভগৃহের। উপর এবং নীচে দুটি গর্ভগৃহেই এই রীতি প্রয়োগকরা হয়েছে।
রত্নগুলি স্থাপিত হয়েছে দুটি তলাতে ছাউনির মাথায় বেদী নির্মাণ করে। প্রতিটি রত্নই কলিঙ্গধারায় শিখর-দেউল রীতিতে নির্মিত। সেগুলিতে কলিঙ্গ প্রভাবে রথ-বিভাজন এবং পীঢ়-রীতির প্রয়োগ দেখা যায়। কেন্দ্রীয় রত্নটিতে পঞ্চ-রথ এবং বাকি আটটি রত্নে ত্রি-রথ বিভাজন। ন’টি রত্নেরই মাথায় গন্ডী অংশে পীঢ় বা ভূমির সমান্তরালে সরলরেখায় থাক-কাটা। মন্দিরে এই দুটি রীতির প্রয়োগ করা হয় মুখ্যত সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য।
রত্নগুলির শীর্ষক অংশও সুরচিত– বেঁকি, আমলক, ঘন্টা, কলস, চক্র দিয়ে সাজানো হয়েছে।
কিন্তু পরিতাপের কথা হল, কোনও অলংকরণ নাই মন্দিরে। থাকার মধ্যে কেবল দুটি দ্বারপাল মূর্তি, গর্ভগৃহে প্রবেশপথের দু’দিকে।
তবে, সুদৃশ্য একটি রাস-মঞ্চ আছে এই মন্দিরের সামনে। রাসমঞ্চ হল বাংলার অন্ত-মধ্যযুগীয় মন্দির-স্থাপত্যের নিদর্শন। অপরদিকে আরও একটি কথা বলা যায়, রাসমঞ্চ হোল রত্নমন্দিরের সংক্ষিপ্ত নমুনা। মেদিনীপুর জেলায় যত রাসমঞ্চ আছে, তার অধিকাংশই নব-রত্ন রীতির। মহাপ্রভু মন্দিরের এই মঞ্চটিও নব-রত্ন রীতিতে নির্মিত হয়েছে।
রাসমঞ্চের ভিত্তিবেদীটি বেশ উঁচু। বেদীর উপর একটি প্রদক্ষিণ-পথও আছে মঞ্চের চার দিক জুড়ে। মাথায় সমতল ছাদ এবং ‘বেহারী -রসুন’ রীতির চূড়া। মূল মন্দিরে অলংকরণ না থাকলেও, রাসমঞ্চটি সাজানো হয়েছে বহুসংখ্যক টেরাকোটা ফলক দিয়ে। আটটি দ্বারপথের দু’পাশে এবং আটটি কার্নিশে পৃথক পৃথক সারিতে ফলকগুলি সাজানো।
টিনের ছাউনি দেওয়া প্রাচীন একটি নাটমন্দিরও আছে মন্দিরের সামনে। কিন্তু মন্দির, রাসমঞ্চ এবং নাটমন্দির– তিনটিরই ভারী জীর্ণ দশা। অবিলম্বে সংস্কার না করা হলে, ধ্বংস হয়ে যেতে দেরী লাগবে না।
সাক্ষাৎকার : সর্বশ্রী গৌতম চক্রবর্তী, সৌরভ চক্রবর্তী, তুষার চক্রবর্তী– বাসুদেবপুর।
যাওয়া – আসা : পাঁশকুড়া স্টেশন এবং ঘাটাল মহকুমা শহর– এই দুইয়ের সংযোগকারী পথের উপর বৈকুণ্ঠপুর স্টপেজ। সেখান থেকে চন্দ্রেশ্বর খালের পাড় ধরে পূর্বমুখে সামান্য এগিয়ে বামহাতি পাড়ায় গোস্বামীদের বসত এবং মন্দির।

RELATED ARTICLES

Most Popular