Homeএখন খবরমেদিনীপুর শহরের প্রান্তজনের সখা স্বাধীনতা সংগ্রামী গুজিবাবুকে স্মরণ করল 'দ্য ভয়েস অব...

মেদিনীপুর শহরের প্রান্তজনের সখা স্বাধীনতা সংগ্রামী গুজিবাবুকে স্মরণ করল ‘দ্য ভয়েস অব মিদনাপুর’

নিজস্ব সংবাদদাতা: স্বাধীনতা আন্দোলনের পীঠস্থান মেদিনীপুর শহর সর্বার্থে আধুনিক ছিলনা বরং নবাবি জামানা পেরিয়ে ইংরেজ জামানাতেও অস্পৃশ্যতা ছিল এ শহরের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। কাকভোরে উঠে শহরের ময়লা আবর্জনা আর মলমূত্র পরিষ্কার করে পরের দিনের জন্য শহরকে ঝাঁ চকচকে রাখতেন যাঁরা সেই তথাকথিত ধাঙড় অথবা মেথররা ছিল এ শহরের কাছে অচ্ছুৎ। অথবা সন্ধ্যা হলেই শহরের ‘বাবু’রা হাতে বেলিফুলের মালা জড়িয়ে আর গিলে করা পাঞ্জাবি গলিয়ে যে নিষিদ্ধ পল্লীগুলিতে আসর জমাতেন আর মধ্যরাতে টলমলে পায়ে নিধুবাবুর টপ্পা গাইতে গাইতে ফুটপাত বদল করতে করতে বাড়ি ফিরতেন। সেই পল্লীগুলিই দিনের আলোয় পুরসভার পরিষেবাহীন হয়ে পড়ে থাকত। সমাজের এই অস্পৃশ্য অচ্ছুৎ মানুষের দেবতা ছিলেন বঙ্কিম বিহারী পাল ওরফে গুজিবাবু। যিনি স্বাধীনতার পরে ‘কাজ মিটে গেছে’ বলে পেনশনে সন্তুষ্ট হয়ে যেমন ঘরে বসে থাকেননি তেমনই সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের হোমড়া চোমড়া হয়ে সুখের জীবন অতিবাহিত করেননি। আজীবন প্রতিবাদী মানুষটির ১১৭তম জন্মদিন পালন করলেন মেদিনীপুর শহরের একটি সংগঠন, দ্য ভয়েস অব মিদনাপুর।

মেদিনীপুর পৌরসভার সম্মুখে একটি করোনাকালীন বিধি নিষেধ মেনেই একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই স্মরণ কর্মসূচি উৎযাপন করেন দ্য ভয়েস অব মিদনাপুরের সদস্যরা। সংস্থাটির তরুণ সদস্য মেদিনীপুর এর ঐতিহ্য অনুসন্ধানী, লেখক, সমাজকর্মী শিবদেব মিত্র জানিয়েছেন- ‘ শুরু থেকেই অহিংস পথেই স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন গুজিবাবু বা বঙ্কিম বিহারী পাল। যখন ইংরেজদের আনুগত্যই বাবুকুলের জমিদারি টিকিয়ে রাখার একমাত্র পথ তখন মানিকপুরের পাল পদবিধারী এই জমিদার নন্দন ছিলেন দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। সাধারণ ভাবে জমিদার নন্দনেরা শহরের নিষিদ্ধ পল্লীতে যেতেন ফুর্তি করতে কিন্তু গুজিবাবু যেতেন স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের অনুপ্রাণিত করতে আর এভাবেই বারবণিতাদের একটি অংশকে জুড়ে নিয়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল স্রোতে। নিষিদ্ধ পল্লীতে যাওয়া ইংরেজ রাজপুরুষ কিংবা নেশাতুর বাবুদের কাছ থেকে তাঁরাই বের করে নিতেন সরকার বাহাদুরের নানা পরিকল্পনা। আর এই কাজের জন্য একজন বারবনিতাকে বিয়ে করে সাধের জমিদার বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকি বাস করতে শুরু করলেন নিষিদ্ধ পল্লীতেই।”

মেদিনীপুরে গান্ধীজির আগমনকালে(১৯২১) গুজিবাবুর বয়স ১৬বছর। কিন্তু সেই সময়েই গান্ধীজির প্রভাব বদলে দিয়েছিল এই জমিদার নন্দনকে। স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুধু দেশের মুক্তিই নয় দেশের অভ্যন্তরে থাকা অগণিত প্রান্তিক আর অচ্ছুৎ মানুষের দেশীয় সমাজেরই তৈরি করা অস্পৃশ্যতা থেকে মুক্তি, গান্ধীজির এই ভাবনাকেও গ্রহণ করেছিলেন তিনি আর এখানেই ছিল তাঁর ভাবনার বিশিষ্টতা, তাঁর একলা চলার পথ। আর সেই পথেই প্রাক স্বাধীনতা পর্বে মেদিনীপুর শহরে হরিজন আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ছিলেন। হরিজনপল্লী থেকে নিষিদ্ধ পল্লী কাঁধে হারমনিয়াম ঝুলিয়ে গান গেয়ে সংগঠিত করতেন প্রান্তজনেদের। যে কারনে তাঁকে কটাক্ষ করা হয়েছে ‘বেশ্যা পাড়ার মাস্টার ‘ যা পরবর্তীকালে বহুল আলোচিত হয়েছে।

উত্তর স্বাধীনতা পর্বে গুজিবাবু শহর সংগঠক। স্বাধীনোত্তর পরবর্তী মেদিনীপুর পুরসভার নানা গুরুভার সামলেছেন কৃতিত্ব ও ব্যাপক জনপ্রিয়তার সঙ্গে। আর সেই সময় স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদদের চিরস্মরণীয় করে রাখতে সতীর্থ কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন মেদিনীপুর শহর শহীদ প্রশস্তি সমিতি। যদিও সংগ্রাম থামেনি তারপরও। সাতের দশকে সারা দেশের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল স্বৈরাচারী শাসন আর বাংলার জন্য কুখ্যাত অরাজকতা। দেশজুড়ে নতুন সূর্যের খোঁজে পথে নেমেছেন জয়প্রকাশ নারায়ন, গুজিবাবুও সেই পথের পথিক হলেন। ১৯৭৭ সালে দেশজুড়ে সেই স্বৈরাচারিতার জবাব এল সাধারণ নির্বাচনে। জনতা দলের তরফে মেদিনীপুর বিধানসভার মানুষ গুজিবাবুকেই বিধায়ক নির্বাচন করে জবাব দিলেন। সেই পদে থেকেই ২বছরের মাথায় ১৯৭৯ সালে মেদিনীপুর শহর হারালো একজন আদ্যান্ত আধুনিক মানুষকে। ১১৭তম জন্মদিনে মেদিনীপুরবাসীর হয়ে তাঁকেই স্মরণ করলেন দ্য ভয়েস অব মিদনাপুর। তাঁর আবক্ষ মূর্তি তে মাল্যদান করেন সংগঠনের তরফে বাসুদেব চক্রবর্তী, বিশ্বনাথ সাহু, শিবদেব মিত্র প্রমুখরা।

RELATED ARTICLES

Most Popular