Homeএখন খবর'বিজেপির ভাষায় কথা বলছে মন্ত্রী!' তৃনমূলের অন্দরে রাজীব আতঙ্ক, প্রকাশ্যে দুই মন্ত্রীর...

‘বিজেপির ভাষায় কথা বলছে মন্ত্রী!’ তৃনমূলের অন্দরে রাজীব আতঙ্ক, প্রকাশ্যে দুই মন্ত্রীর দ্বন্দ্ব, বিধানসভার আগেই কোন্দল বিধ্বস্ত শাসকদল

বিশেষ সংবাদদাতা: দলের নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার বলছেন দলে থেকে কোনও রকম দুর্নীতিকে বরদাস্ত করা হবে না । কোন রকম ভাবে আপোস করা হবে না দুর্নীতির সঙ্গে । কারোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে । দলের নেত্রীর এই কথা বলার পরেই রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক নেতা, পঞ্চায়েতের পদাধিকারীদের সাসপেন্ড করা হয়েছে । তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা। বিশেষ করে আমফান ঝড়ের পরে ত্রাণ বিলি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর এই পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেস।

কিন্তু এই দুর্নীতির ইস্যুতেই প্রকাশ্যেই কাদা ছোড়াছুড়িতে জড়িয়ে পড়লেন রাজ্য মন্ত্রিসভার দুই সদস্য। বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সমবায় মন্ত্রী তথা হাওড়া জেলার তৃণমূল সভাপতি অরূপ রায়। ঘটনাচক্রে দুজনেই হাওড়ার মন্ত্রী। দুই মন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের নেতার এই বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতির লড়াইয়ে অস্বস্তিতে শাসক দলের শিবির। রাজ্যের আরেক মন্ত্রী তথা দলের তরফে হাওড়া জেলার পর্যবেক্ষক ফিরহাদ হাকিম বলেছেন যে দলের কারোর কোন বিষয় নিয়ে কারোর কিছু বলার থাকলে দলের মধ্যে বলতে হবে। কেউ প্রকাশ্যে এই বাবে বিবৃতি দিতে পারেন না ।

হাওড়া জেলার এই দুই নেতার দ্বন্দ্বে নতুন করে সরগরম হয়ে উঠেছে বঙ্গের রাজনীতি । আর আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনে আগেই নতুন সমীকরণ নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে।

যে ভাবে দুর্নীতি নিয়ে দলের জেলার নেতৃত্বর বিরুদ্ধে মুখ খুললেন রাজীব ব্যানার্জি তাতে ক্ষুব্ধ দলের একাংশ । তারা বলছেন যে রাজীব ব্যানার্জি বিজেপির ভাষাতে কথা বলছেন । অর্থাৎ, বিজেপি দলে যেতে চাইছেন রাজীব ব্যানার্জি ।

এই নিয়ে রাজ্যের বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, বিবেকের তাড়নায় এই সব কথা বলেছেন রাজীব ব্যানার্জি । তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে থেকে এই ভাবে কেউ বলতে পারে না । তবে রাজীব ব্যানার্জি অন্য ধরনের মানুষ ।

দুর্নীতির অভিযোগে রাজ্যের বেশ কয়েকজন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা, পঞ্চায়েতের পদাধিকারীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে । এদের মধ্যে আছেন হাওড়া জেলার তিনজন । ঘটনাচক্রে তারা তিনজনেই ডোমজুড়ের বিধায়ক তথা রাজ্যের বনমন্ত্রীর অনুগামী হিসেবে হাওড়া জেলায় পরিচিত ।

আর দুর্নীতির দায়ে তিন অনুগামীকে দল থেকে বহিষ্কারের পরেই বোমা ফাটালেন ডোমজুড়ের বিধায়ক তথা রাজ্যের বনমন্ত্রী। দলের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগে সরব হন তিনি। মূল নিশানা আরেক মন্ত্রী তথা হাওড়া জেলার তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অরূপ রায় হলেও, তৃণমূলে যোগ্য লোকেদের মূল্য নেই বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
রাজীব ব্যানার্জি বলেন, ‘যারা যোগ্যতার সঙ্গে কোনও কাজ করতে চায় তাদের সঠিকভাবে সেই সুযোগ করে দেওয়া হয় না। যোগ্যতার বিচার পায় না। কিছুটা হলেও আমার মধ্যে বেদনা রয়েছে। আমি মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কাজ করতে দেওয়া হয়নি।‘

শুক্রবার আমফানের ত্রাণ দুর্নীতিতে দলের ৩ নেতাকে সাসপেন্ড করেন জেলা সভাপতি অরূপ রায়। এর পরই শনিবার প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন রাজীব। সূত্রের খবর, বহিষ্কৃত ৩ নেতা রাজীব গোষ্ঠীর। রাজীব ব্যানার্জি অভিযোগ করেন, ‘হাওড়া শহরের ৩ নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও জেলা সভাপতি তাদের বিরুদ্ধে কোনও রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। বেছে বেছে চুনোপুঁটিদের ধরা হচ্ছে। বাদ পড়ছে রাঘব বোয়ালরা।’

এর পর ফেসবুক লাইভে এসে বোমা ফাটান রাজীব। বলেন, হাওড়ায় দলে একনায়কতন্ত্র চলছে। তিনি দলের কো-অর্ডিনেটর হলেও বৈঠকে ডাক পান না।

দলীয় সূত্রে খবর, যাঁদের শোকজ করা হয়েছে, তাঁরা দু’জনেই আবার অরূপ গোষ্ঠীর লোক। সাসপেন্ড হয়েছেন সাঁকরাইল পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জয়ন্ত ঘোষ, ডোমজুড়ের উত্তর ঝাপড়দা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের স্বামী সুমন ঘোষাল ও জগৎবল্লভপুর পাতিহাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান বেচারাম বোস। শোকজ করা হয় বড়গাছিয়া ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান শবনম সুলতানা এবং জগৎবল্লভপুর এক নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান শেখ নুর হোসেনকে।

এই সাসপেনশনের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, “হাওড়া শহরে দলের ৩ নেতার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। দল এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিলেও জেলা সভাপতি কিছু করেননি।”

রাজীব আরও অভিযোগ করেন, “আমি হাওড়ায় দলের কো-অর্ডিনেটর। অথচ আমার কোনও মতামত নেওয়া হয় না। কোনও বৈঠকে ডাকা হয়‌ না।”

রাজীব , ‘মমতা বলেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে গেলে দল থেকে সার্বিকভাবে দুর্নীতি দূর করতে হবে। কয়েকজন চুনো পুঁটিকে দেখিয়ে আমি দুর্নীতি রোধ করতে পারব না। প্রচুর রাঘব বোয়াল, রুই, কাতলা, ইলিশ আছে। তাদেরও বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। দল দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলেছে। নেত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। আর আমি বললেই তা দোষের। আমি মানুষের জন্য কাজ করি। তাই করব। এর জন্য যা মূল্য চোকাতে হবে তা চোকাবো।’

জবাবে অরূপ রায় বলেন, ‘দলের নির্দেশ মেনেই পদক্ষেপ করেছি। দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় দলকে জানানো উচিত। প্রকাশ্যে মুখ খোলা উচিত নয়। আর ব্যবস্থা নেওয়ার নামে তো দলটাকে ফাঁকা করে দিতে পারি না। এসব কথা প্রকাশ্যে বলা দলবিরোধী কাজের সামিল।‘

পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে ময়দানে নামতে হয় তৃণমূলের হাওড়ার পর্যবেক্ষক ফিরহাদ হাকিমকে। তিনি বলেন, ‘কারও কোনও অভাব অভিযোগ থাকলে দলকে জানাতে পারেন। তাতে কাজ না হলে সরাসরি দলনেত্রীকে জানাতে পারেন। কিন্তু প্রকাশ্যে মুখ খোলা থেকে বিরত থাকতে হবে ।

রাজীবের অভিযোগ, কেউ কেউ কারোর ঘনিষ্ঠ বলে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এলেও কোনও রকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আর অরূপ রায়কে নিশানা করে বলা এই কথার জবাবে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি রাজীবের নিষ্ঠা ও একাত্মতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তৃণমূল কংগ্রেসের হাওড়া জেলার সভাপতি বলেন, “উনি সাচ্চা তৃণমূল কর্মী হলে, মিডিয়ায় এসব বলতেন না। কোনও অভিযোগ থাকলে দলের মধ্যেই বলতে পারতেন।”

অরূপ রায় বলেন, “আমি যা করেছি, তা রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর সঙ্গে কথা বলেই করেছি।”

এই সঙ্গে অরূপ রায় বলেছেন, “ রাজীব কে বৈঠকে ডাকা হয় না বলে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। অনেক বার প্রেস কনফারেন্সে ডেকেছি। কিন্তু উনি কখনওই আসেন না। সমস্ত তথ্য প্রমাণ রয়েছে।”

হাওড়া জেলার রাজনীতিতে অরূপ-রাজীবের সম্পর্ক আদায় কাঁচকলায়। তবে এভাবে দুজন কখনই প্রকাশ্যে কোন্দলে জড়িয়ে পড়েননি।

এদিকে, তৃণমূলের অন্দরের এই ঝগড়া বিরোধী শিবিরে খোরাক জুগিয়েছে।
রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, “রাজীব বিবেকের তাড়নায় এ সব কথা বলছেন। ওই দলে থেকে বিরোধিতা করা যায় না।”
লোকসভায় কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেন, “এখানে বিবেক আবেগের প্রশ্ন নেই। তৃণমূলের কোনও মতাদর্শ নেই। ওদের একটাই মতাদর্শ। তা হল আখেড় গোছাও।” তিনি বলেন, “এক জন মন্ত্রী তাঁর দলের কর্মী, নেতাকে চুনোপুঁটি, রাঘববোয়াল, রুই, কাতলা, ইলিশ – যা নয় তাই বলছেন। মানে দলের পারস্পরিক মর্যাদাবোধটাই নেই।”

ফিরহাদ হাকিম। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “এভাবে প্রকাশ্যে একে অন্যের বিরুদ্ধে বলা অন্যায়। প্রত্যেকেই দলের সদস্য। কারও কিছু বলার থাকলে দলের মধ্যে বলুন। তাতে কাজ না হলে দলনেত্রীকে বলুন।”

তবে রাজীব ব্যানার্জির এভাবে মুখ খোলা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে নয়া জল্পনা তৈরি হয়েছে। তবে কি তিনি বিজেপির দিকে ঝুঁকছেন। রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে জোর চর্চা চলছে।

প্রসঙ্গত এর আগে আমফান নিয়ে দুর্নীতির ইস্যুতে মুখ খুলেছিলেন রাজ্যের আরেক মন্ত্রী সাধন পান্ডে । বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি । তার পরে একটি অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা যায় এক বিজেপি নেতাকে। এই নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয় । এই সঙ্গে জল্পনাও সৃষ্টি হয় যে সাধন পান্ডে যোগ দিচ্ছেন বিজেপিতে।

যদিও এই নিয়ে কোনও রকম কথা বলেনি বিজেপি নেতারা। তারা শুধু রহস্য রেখে বলেছেন যে তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক প্রথম সারির নেতা ও মন্ত্রী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন । আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনে আগেই তারা যোগ দেবেন পদ্ম শিবিরে ।

RELATED ARTICLES

Most Popular