Homeএখন খবর" আমরা বুঝি শহর থেকে বেরিয়ে এলাম " শঙ্খ ঘোষ প্রণামে কবি...

” আমরা বুঝি শহর থেকে বেরিয়ে এলাম ” শঙ্খ ঘোষ প্রণামে কবি আশিস মিশ্র

  • ” আমরা বুঝি শহর থেকে বেরিয়ে এলাম “
                                                 আশিস মিশ্র                  সেই কতবছর আগে ‘ বাবরের পার্থনা ‘ পড়েছিলাম। মাঝে মাঝে আরও কত কী। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল মুহূর্তে। আর কিছু মনেই পড়ছে না। শুধু মনে হয় এসময় আমরা কেউ কেউ ‘ ডিফিকালটি ওভারকাম ‘ করতে হয়তো পারবো, হয়তো পারবো না।

স্নান সেরে সবেমাত্র বসেছি, দুঃসংবাদটি পাঠালো বন্ধু কমল বিষয়ী। মনে পড়ে গেল, হলদিয়া উৎসবের কিছু স্মৃতি। তাঁর মুখের কথাই যেন কাব্য, কখনো প্রবন্ধ। তাঁর কত নিকটজন একে একে চলে গেছেন। অশ্রুকুমার সিকদার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত থেকে বাংলা সাহিত্যের এক এক নক্ষত্র। তবুও তিনি তো ছিলেন আমাদের এক পরম আশ্রয়। দুদণ্ড তাঁর কাছে বসে আসতে পারলেও শান্তি!

এমনই কয়েক ঘন্টা তাঁর সঙ্গে কেটেছিল আমাদের। হলদিয়া সেই স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে। সালটি মনে নেই। সেবার সস্ত্রীক হলদিয়া উৎসবে এসেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ ও প্রতিমা ঘোষ। হলদিয়া উৎসবের প্রাণপুরুষ প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠের আহ্বানে। উপলক্ষ শঙ্খবাবুকে অর্পণ করা হবে ‘ অন্নদাশঙ্কর রায় স্মৃতি পুরস্কার ‘। হলদিয়া টাউনশীপের হ্যালিপ্যাড ময়দানে উৎসবের মূল মঞ্চে সন্ধ্যায় তাঁর হাতে এই পুরস্কার অর্পণ করেন লক্ষ্মণবাবু।
তারপর কবি তমালিকা পন্ডাশেঠ আমাকে ও কবি জহরলাল বেরা বললেন, শঙ্খদা ও বৌদিকে কলকাতার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসো। টাউনশীপ থেকে একটি ট্যাক্সি নিয়ে আমরা সস্ত্রীক কবিকে নিয়ে রওনা দিলাম কলকাতার উদ্দেশে।

রানিচক রেলগেট পেরিয়ে ৪১ নং জাতীয় সড়কে উঠতেই শঙ্খবাবু বললেন, ‘ আমরা বুঝি শহর থেকে বেরিয়ে এলাম ‘। আমি বললাম, হ্যাঁ।
কী কথা বলবো তাঁর সঙ্গে, ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই চুপচাপ বসেছিলাম। কোলাঘাটের কাছে শের ই পাঞ্জাব ধাবায় এসে আমাদের গাড়ি দাঁড়ালো। পনির পকোড়া আর চা খেলেন তিনি ও প্রতিমা ঘোষ। সেই টুকু আড্ডার মুডে তিনি বেশ খুশি ছিলেন।
গাড়ি চলতে থাকলো। শীতকাল। আকাশে গোল চাঁদ। তখন মুম্বাই রোড় সোনালী চতুর্ভুজের আওতায় আসেনি। একটিই চওড়া রাস্তা। একেবারে উল্টোডাঙা। রাত ১০ টা নাগাদ তিনি নেমে গেলেন আমাদের গাড়ি থেকে। বললাম,ভালো থাকবেন আপনি ও বৌদি।

এর পরও বার তিনেক তাঁর বিদ্যাসাগর আবাসনের বাড়িতে গেছিলাম। একবার দেখা হয়। দুবার তিনি ছিলেন না।
এই সংকটকালে তাঁর চলে যাওয়া বাংলা সাহিত্য জগতে যে শূন্যতা নেমে এলো, তা আর কখনো পূরণ হবে না।
কবিতা নিয়ে তাঁর যা কিছু বলার ছিলো, যা তিনি বলতে চেয়েছিলেন, যেভাবে বলতে চেয়েছিলেন, তা বলা হয়েছে। শেষটুকু আর বলা হলো না। তাঁর গদ্য আমাদের কাছে এক আলোবাতাস। সেখানে ডুব দিলে পাঠকের বোধ ও আত্মমগ্নতার যে স্ফুরণ ঘটে, তা চিরকালীন মনে হয় । শুধু কবি নয়, তিনি এ যুগের এক মহান দার্শনিকও বটে। প্রতিবাদী চরিত্রটি বজায় রেখেছিলেন আজীবন। ” আয় সবে বেঁধে বেঁধে থাকি ” এ এক অমোঘ চরণ। তাঁর কবিতায় যে ভারতীয়ত্ব বোধ ও আত্মমগ্নতা, আশাবাদ, তা বাংলা কবিতার জগতকে বিশ্বজনীন করে তুলেছে। তিনি বাংলা কবিতার বিশ্বনাগরিকও বটে। তাঁর কাব্যভাষা, গদ্যভাষা অন্য কোনো কবির সঙ্গে মেলে না। ধূম লেগে থাকা হৃৎকমল আজ বড়ো বিষণ্ণ। সেখানে পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই ভগ্ন সমাজের, অসহিষ্ঞু সমাজের চোখে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে যখন, তখন তিনি যেন তা মুছিয়ে দেন তাঁর ভাষায়। সর্বোপরি বাংলা ভাষায়। বাঙালি তাঁর কাছে বারবার নতজানু হয়ে বসেছে।

জানু পেতে বসে বাবরের সেই পার্থনার সুর বাজছে কানে। সকলের মঙ্গল চাইছেন তিনি। সকলে এক সঙ্গে আজ এসো বেঁধে বেঁধে বেঁচে থাকি। সেখানে প্রেম ছাড়া আর কিছু নেই। যদিও ” হাতের উপর হাত রাখাটা সহজ নয় ” তবুও সহজ — কারণ কবি তো ভাঙনের দিকে নিয়ে যান না। তিনিও কখনো হতাশায় বিশ্বাস করতে চাননি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর অজস্র প্রবন্ধের বই পড়তে পড়তে কবিগুরুর সেই শাশ্বত চরণ মনে পড়ে — ” তোমার শঙ্খ ধূলায় পড়ে কেমন করে তা সইব.. “!!

RELATED ARTICLES

Most Popular