Homeঅন্যান্যপৃথিবী কি ফিরছে চেনা ছন্দে? পরিবেশ দিবসে ফিরে দেখা ! শুভময় দাস

পৃথিবী কি ফিরছে চেনা ছন্দে? পরিবেশ দিবসে ফিরে দেখা ! শুভময় দাস

অধ্যাপক শুভময় দাস

পৃথিবী কি ফিরছে চেনা ছন্দে? -পরিবেশ দিবসে ফিরে দেখা
(‘ভাম’ বলে যে প্রাণীটিকে ঘৃণার সঙ্গে আমরা রিরংসা উগরে দেই, আমরা কী জানি শুধু ওই ঘৃণাটুকুর জন্যই ওরা আজ বিপন্ন? প্রতিদিনই কোথাও না কোথা থেকে উঠে আসে এই সব ভাম, বনবেড়াল, ম্যাকরোল, মেছো বেড়ালকে পিটিয়ে মারার ঘটনা আর অন্তরালে আমাদের জান্তব উল্লাস! আমাদের অর্জিত মূর্খতার প্রতিদিন এদেশের নদ-নদী সমুদ্র খাড়িতে কত রকমের ডলফিন মারা পড়ে? গৃহস্থের হিসাবের খাতার মতই প্রতিদিন এই প্রাণ খরচের হিসাব রাখেন অধ্যাপক শুভময় দাস। শুধু তাই নয় খবর পাওয়া মাত্রা একদল ছাত্রছাত্রী নিয়ে ছুটে যান তিনি। বনদপ্তর, পুলিশ, সাধারণ মানুষের চোখরাঙানি, হুমকি কী পাননা বিনিময়ে? তাঁর চোখ দিয়ে জল ঝরে, কাঁদেন। না, মানুষের দেওয়া অপমানে নয়, ভামবেড়ালের অসহায় মৃত্যুতে। পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজ কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রখ্যাত ডলফিন গবেষক অধ্যাপক শুভময় দাস বিশ্ব পরিবেশ দিবসে কলম ধরেছেন দ্য খড়গপুর পোষ্টের জন্য।

“আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ” l প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা পৃথিবী আজ দমবন্ধ ক’রে সময় কাটাচ্ছে l এক বছর মানুষ গৃহবন্দী l এই মানুষই পৃথিবী ধ্বংসের অন্যতম কারিগরl অতিমারি তার এক মন্ত্রে মানুষকে বেঁধে ফেলেছেl গৃহবন্দী করেছে অজানা আতঙ্ক আর মৃত্যুভয়ের অদৃশ্য পাশেl এই অতিমারি প্রায় দেড় বছর হতে চললl কেমন আছে প্রকৃতি? সে কি সুস্থ হয়ে উঠছে আবারও? নির্মল হচ্ছে ক্রমশ নাকি অন্য কোন দিকে মোড় নেবে নাটকীয়ভাবে?                                      মোট কথা :-
এই পৃথিবীটা স্রষ্টার এক জটিল সৃষ্টিl শিরায় শিরায় গ্রন্থি আর জটিলতা l এত সহজে বলা যাবে না এর উত্তর l এত কম সময়ের নিরিখে ভালো মন্দ- লাভ ক্ষতি বলা মুশকিল এবং মুর্খামিl তা সত্ত্বেও এক কথায় যদি বলতে হয় -প্রকৃতি কেমন আছে – তাহলে বলি আপাতত সাময়িক রোগের উন্নতি হয়েছেl স্বল্পমেয়াদী ফলাফল এটা l আর দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ – আরো ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে- ধ্বংসের দিকে এগিয়েছে আমাদের পরিবেশ প্রকৃতি আর ভবিষ্যৎl

আমাদের বাতাস কি লকডাউনে পরিশুদ্ধ?
হয়েছে মানছি l বাতাসে যে উপাদান- তাতে যে দূষক পদার্থ থাকে তার পরিমাণ কমেছে l পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যে গবেষণা হয়েছে তাতে একটা জিনিস পরিষ্কার যে বাতাস সমগ্র বিশ্বে কিছুটা হলেও পরিচ্ছন্ন হয়েছেl তার গুনে ও মানে l গ্রীন হাউস গ্যাসের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে l কার্বন-ডাই-অক্সাইড 17 %, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড 40 %, সালফার ডাই অক্সাইড 5%, লেড 7% কমেছে l কিন্তু সে তো সাময়িক l গাড়ি-ঘোড়া কম চলেছে,জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কম হয়েছে তাই বাতাস স্বচ্ছ l নির্মাণকার্য হয়নি তাই ধুলো ও ভাসমান ধূলিকণা খুব কম l দৃশ্যমানতা বেড়েছেl হিমালয় কিংবা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া বরফ দেখা যাচ্ছে l সব্বাই আনন্দে l ট্যুরিজম বন্ধ- তাই হিমালয় -সাগর- বন-জঙ্গলের দূষণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে l কিন্তু আজ বাদে কাল আবার গাড়ি-ঘোড়া চলবে- পুরনো ক্ষতি উসুল করবার জন্য বেশি সময় ধরে বেপরোয়াভাবে চলবে সবকিছু l সুদে আসলে উসুল করে নেবে l ক্ষত যতটা ছিল তারচেয়ে অনেক গভীর হবেl এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স বেড়েছে- সত্যি l ভারতবর্ষে 12.5% মৃত্যু হয় বায়ুদূষণেl এটা কিছুটা কমেছে l শব্দদূষণ কমেছে l বন্যপ্রাণীরা শান্তিতে আছে l জুনোটিক বা প্রাণীঘটিত অসুখ 20% কমেছে l

জলের গুণগত মান উন্নতি হয়েছে?
আপাত ভাবে কিছুটা l জলের গুণগত মান কিছুটা বেড়েছে l স্টিমার লঞ্চ জলযান কমেছে l কারখানা বন্ধ -বর্জ্য পদার্থ নালা বেয়ে নদীখালে কম মিশেছে l পূজা-পার্বণ এবং জমায়েতে খানিকটা নিয়ন্ত্রণ থাকায় জলের স্বচ্ছতা বেড়েছেl দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ 6% থেকে 8 % বেড়েছেl ভালো লক্ষণ l বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড কমেছে 4 %থেকে 3% l যমুনার জল স্বচ্ছ হয়েছে- বিষাক্ত ফেনা আর হচ্ছেনা l কানপুর বারাণসীতে একই ঘটনা দেখা গেছে l জলে বিষ এবং ভারী ধাতুর পরিমাণ কিছুটা কমেছেl কিন্তু সত্যিই কি তাই? আমি এসব মনে করিনাl জল দূষণ কমেইনি একেবারেইl

llজল দূষণ বেড়েছে ll
আচ্ছা দেখুন তো -আমাদের খাওয়া-দাওয়া কি কমেছে? জীবন প্রণালী কি পাল্টেছে? কৃষি উৎপাদন কমে নিl চাষাবাদ একই আছে l গ্রাম সচল আছে l কৃষিতে ভূগর্ভস্থ জল আগে যতটা ব্যবহার এবং অপচয় হতো -তাই হয়েছে l পৃথিবীর গর্ভ গত একবছরে আরো বেশি শুকিয়েছে l ফসলে কীটনাশক ব্যবহার একফোঁটাও কমেনি l কীটনাশকে ব্যাঙ ব্যাকটেরিয়া মাটি মাকড়সা, কেঁচো কেন্নো কারুরই মৃত্যু স্রোত কমেনি l সারের ব্যবহার একফোঁটাও কমেনি l মাটির ক্ষয় কমেনি l মাটি এবং ভূগর্ভস্থ জল দূষণ আগেকার মতোই ভয়াবহ l কি ভাবে আর কি ভেবে বলি- জল দূষণ কমেছে? জলের স্বচ্ছতা দেখে গুণমান বিচার করা খুব বোকামি l এক বছরে কারখানার জলশোধনের নতুন কোনো প্লান্ট বসেনি l নদীবুকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেমে থাকে নি, পাহাড়ে ধস কমেনি, সমুদ্র ম্যানগ্রোভ বাড়েনি l না সমুদ্র না সমতল কেউ ভালো নেই l আপাত মলম নিয়ে সন্তুষ্ট সব্বাই l দীর্ঘমেয়াদি অবনতি হয়েছে l

llজীববৈচিত্র কমে গেল ll
আবারো বোকামি l প্রকৃতি এত সহজ আর ঠুনকো নয়l আজ গাড়ি চালানো বন্ধ করলাম -আর কালথেকে জীববৈচিত্র্য বেড়ে গেল হু হু করে? একি ভোজবাজি না যাদুবিদ্যা! আসলে এ দেখবার ভুল lআগে যা প্রাণীবৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য ছিল এখনও তাই আছে l আমরা এতটাই স্বার্থপর আর ব্যস্ত ছিলাম যে ওদের নজর করবার ফুরসতই পাইনিl আগে দুচোখ মেলে তাকাইনি l আগেও চারপাশে থাকত l এখন আমরা কর্মহীন গৃহবন্দি l আমাদের অবসর প্রচুরl ওদের প্রতি চোখ পড়ছে- লক্ষ্য করছি -আদিখ্যেতা করছি l বাঘ হরিণ কুকুর ডলফিন মাছরাঙ্গা এখনও তাই আছে lএকটাও বাড়েনি রাতারাতিl বাড়া সম্ভব নয় l আসলে আগে মানুষের অত্যাচারে কোলাহলে জীবজন্তুরা ভয়ে সেঁধিয়ে থাকতো l এখন মানুষ গৃহবন্দী হওয়ায় পাখি আর জীবজন্তুরা তাদের স্বাভাবিক বাসস্থানের ঘুরে বেড়াতে পারছে l তাই নজরে আসছে l ওদের সংখ্যা বাড়েনিl ওদের আচার-ব্যবহারের সাময়িক পরিবর্তন এসেছেl মগডাল ছেড়ে নিচের ডালে ওরা বাসা বাঁধছে l রাস্তা পারাপার করছেl শেয়াল হাতি হরিণ গোসাপ কারুরই সংখ্যা বাড়েনিl মাঠে কীটনাশক ব্যবহার কমেনি – ব্যাঙের ছানা মরার স্রোত কমেনি – সাপ বাড়েনি – পাখি বাড়েনি l ওদের আচরণগত কিছু পার্থক্য সাময়িকভাবে আমাদের চোখে এসেছে l মানুষ গর্ত থেকে বের হলে ওরা আবার গর্তে ঢুকে যাবেl

তাহলে কি একেবারেই পরিবর্তন আসেনি?
না, সেটা বলার সময় এখনো আসেনি lআমি অতটা বোকা বা বোদ্ধা কোনোটাই নই l বিজ্ঞান পরিবেশ যতটা জানি তার নিরিখেই বলছি এভাবে অন্তত একটানা 14 -15 বছর চলে তবে বলা যাবে পরিবেশের পরিবর্তন হয়েছে কিনা! মাছেদের সংখ্যা বেড়েছে কিনা এটা বলতে গেলে অন্তত বছর 15 অপেক্ষা করতে হবেl তা বাস্তবে সম্ভব নয় বলেই মনে হয় l ইতিমধ্যে পৃথিবীজুড়েই গেল গেল রব লকডাউনের তাণ্ডবেl একটা প্রাণী যার আয়ু 40 বছর তার সংখ্যা বাড়িয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে অন্তত বছর কুড়ি সময় দিতে হবে l তারপর হিসেব-নিকেশের পালা l তখন বলা যাবে বাড়ল না কমল l তবে হ্যাঁ, যে সমস্ত জীবের আয়ুষ্কাল খুব কম অন্তত তিনচার মাস তাদের সংখ্যা ইতিমধ্যে বাড়তেই পারে l তার উপস্থিতি নজর কাড়ে l কিন্তু তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের রিপোর্ট এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীমহলে সাড়া ফেলেনিl আমার জানা নেই l

llকৃষিক্ষেত্রে নয়া বিপর্যয় ll
একমাত্র কিনা বলা মুশকিল l তবে নিশ্চিত হবে কৃষি ক্ষেত্রে শুধু কীটনাশক শুধু নয় আরও অনেক প্রসঙ্গ আছে l সাম্প্রতিক ফসলের গোড়া বা নাড়া পোড়ানোর চল বেড়েছে l কেন? সমাধান কিভাবে? কেউ ভাবিনি এক বছরে! চাহিদা না থাকায় মাঠের পর মাঠ নাড়া পুড়িয়ে যে পরিবেশের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি সেটা কিন্তু এই লকডাউনে একেবারেই কমেনি বরং বেড়েছেl

ll তেল ও গ্যাসের ll
না,আমি সহমত নই l লকডাউনে পাবলিক বাস কম চলেছে- কিন্তু সামগ্রিক যানবাহন কম চলেছেকি? কতটা কম? যাত্রীবিহীন ফাঁকা বাস চলেছে অথবা 80 -90 এর বদলে 20 -22 যাত্রী নিয়ে বাস চলেছে l তাহলে তেলের ব্যবহার কোথায় কম হলো? মানুষ বাস এড়িয়ে বাইক আর প্রাইভেট গাড়ি চেপেছে প্রচুরl প্রাইভেট কারের বিক্রি ও ব্যবহার বেড়েছে আইসোলেশান বজায় রাখতে গিয়ে l তার হিসেব আমাদের কাছে নেই l মানুষ রান্নার গ্যাস ব্যবহার শুরু করেছিল বিনে পয়সায় গ্যাস সংযোগ পাওয়ার ফলেl সাম্প্রতিক গ্যাসের অগ্নিমূল্য l লকডাউনে আবার ডালপালা খড় কুটো কয়লা উনুনে ফিরে গেছে গ্রাম জনপদের গরিব আম আদমি l সেই হিসেবে রাখেনিl সেই হিসেব ধরলে আমরা আতঙ্কিত হবl গত এক বছরে ইনকাম কমে যাওয়ায় গার্হস্থ্য জ্বালানির দূষণ বেড়েছে অনেক বেশিl

llনব্য উৎপাত??
যে ক্ষতির কথা না বললেই নয় তা হলো প্লাস্টিক দূষণl কয়েক হাজার গুণ বেড়েছে l চারদিকে এত সাহায্য অনুদান ত্রান প্রত্যেক ক্ষেত্রে প্যাকেট এ পরিবহন – ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চটজলদি প্যাকেজিং- প্রত্যেক ক্ষেত্রেই পলি প্যাকেট ব্যবহার বেড়েছেl স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিকল্প ভাবেনি l প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ব্যবহার বেড়ে অকল্পনীয় l অনলাইন হোম ডেলিভারির উপরে সমগ্র দেশ বেঁচে আছেl ঔষধ খাবার সবজি বইপত্র পোশাক থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্সl প্রতিটি খুঁটিনাটি জিনিস এর প্যাকেজিংl পৃথক পৃথক ভাবে l মোটা প্লাস্টিকে l প্লাস্টিকর বাবল প্যাকে l চিন্তার বাহিরে l পঞ্চাশ টাকার জিনিসে দশ টাকার পাস্টিক l বই কিংবা কিংবা একটা পেন প্যাকিং করবার সময় প্রচলিত প্যাকিংয়ের থেকে অন্তত 10 গুণ বেশি পলিথিন ব্যবহার করা হচ্ছে l এক একটা আইটেমের জন্য পৃথক পৃথক প্যাকিং l প্রতিদিন রাশি রাশি খাবার ডেলিভারিতে অকল্পনীয় প্লাস্টিক ব্যবহার হয়েছে l হোটেলে সরাসরি খেলে এটা হতো না l আবার প্রত্যেকটা ছোট আইটেমের জন্য যে ডেলিভারি ম্যান পেট্রোল পুড়িয়ে আসছেন সে হিসেব ও আমাদের হিসেবের বাইরেl

কোভিড পরিস্থিতিতে প্লাস্টিক দূষণ বিশাল ধারণ করেছেl মাস্ক, ফেস শিল্ড, হেড ক্যাপ, হ্যান্ডগ্লাভস, পি পি ই কিট, গামবুট,গগলস সবকিছুই প্লাস্টিকl প্রত্যেকদিন বিলিয়ন বিলিয়ন মাস্ক ব্যবহারের পর রাস্তায় জলে নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে l কোথায় যাচ্ছে এসব? লোক নেই হিসেব কষার l এমনকি মৃতদের শরীরের মুড়বার জন্য যে প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হচ্ছে তার হিসেব কেউ করেনি l স্যানিটাইজার ও স্প্রে র প্লাস্টিক বোতল – তার হিসেব আমরা রাখিনি l ব্যবহারে পর ছুঁড়ে দিচ্ছি l জমছে তো l এর পর ন্যানো প্লাস্টিক! পৃথিবীতে প্রত্যেকদিন 3.4 বিলিয়ন ফেস মাস্ক জমছেl তাহলে দেড় বছরে কত প্লাস্টিক এবং কত ফেস মাস্ক জমলো? এরপর মেডিকেল ওয়েস্ট! 10 থেকে 20 গুন বেড়েছেl এর আগে যে প্লাস্টিক ব্যবহার হতো তার রিসাইক্লিং হতোl কিন্তু করোনাকালে কেউই রিসাইক্লিং করছেন না l সুতরাং প্রতি ক্ষেত্রেই নতুন প্লাস্টিকl রিসাইক্লিং করবার মানুষ নেই -কারখানা বন্ধ- সংগ্রহ করার লোক নেই, প্রচার নেই l অবস্থা সঙ্গীনl পুরাসভার ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত l কেউ পরিবেশের খবর রাখিনি l সবাই মাঝে মধ্যে দু একটা ছবি দিয়ে পরিবেশের সুস্থতা বিচার করে আহ্লাদ করিl কোয়ারেন্টাইন,আইসোলেশন আর সোশ্যাল ডিসটেন্সসিংয়ের ঠেলায় হাউজহোল্ড সলিড ওয়েস্ট 15 থেকে 25 শতাংশ বেড়ে গেছে l রেস্টুরেন্টর অনলাইনে অর্ডার 90 শতাংশ বেড়েছে, মেডিসিন 17%, ইলেকট্রনিক্স 40% অনলাইন ডেলিভারি বেড়েছেl সঙ্গে প্লাস্টিকl ওদের সদগতির কোন ব্যবস্থা হয়নিl

llস্যানিটাইজার দূষণ ll
ডিসইনফেক্টান্ট বেহিসাবি ভাবে ব্যবহার করেছিl কোনো আইন-কানুন নেই l জাল-জালিয়াতি তে ভর্তি সবদিক l জীবাণু ভাইরাস কেমন ভাবে মরবে? কেউ জানে না l যা খুশি যেমন খুশি সডিয়াম হাইপোক্লোরাইড, অ্যালকোহল, ব্লিচিং, আইসোপ্রোপানল, হাইপোক্লোরাইড, ক্লোরিন ব্যবহার করেছি বেহিসাবী অপরিমিত ভাবে l নিয়ন্ত্রণ হীন l এতে আদৌ কোন লাভ হয়েছে কিনা কেউই জানিনা! অন্তত ভাইরাস মরবে না সেটা নিশ্চিত l কিন্তু কিছু বন্ধু ব্যাকটেরিয়া পোকামাকড় অনুজীব মাছ ও খাদ্য শৃঙ্খলে থাকা বন্ধু ননটার্গেট জীবসমূহ মরে উজাড় হয়ে গেলl আমাদের দৃষ্টি কেবল হাতি বাঘ আর পাখির দিকেl অথচ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নাম না জানাদের অবস্থা আমরা ভাবলাম না l এটা করতে করতে যখন দশবিশ বছর পরে বাঘ হাতিতে এসে ঢেউ লাগবে -তখন বড্ড দেরী হয়ে যাবে! অবশ্য এ নিয়ে ভাবার দায় বা দায়িত্ব আমাদের নেই l সবই সরকারের কাঁধে সোঁপে আমরা নিশ্চিন্তে l বর্তমান কে নিয়ে সবাই খুশী l এখনো বুঝে উঠতে পারলাম না কোভিদ কি? অথচ শূন্যে তরবারি ঘুরিয়ে ঢেলে যাচ্ছি গ্যালন গ্যালন বিষ l জীববৈচিত্র উজাড় হয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দেl আমরা জীবাণুনাশী যে সমস্ত সাবান ব্যবহার করছি তাতে ট্রাইক্লোকার্বন ও ট্রাইক্লোশান রাসায়নিক থাকেl এতে ভাইরাস তো মরে না উপরি -ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধশক্তি বেড়ে যাচ্ছে l এই রাসায়নিক আমাদের শরীরে ঢুকলে এটা হারমোনের বদলি হিসেবে কাজ করছে l হারমোনের সূক্ষ্ম জটিল সাম্যবস্থা কে তছনছ করে দেয়l আমাদের প্রজনন হরমোনের ভারসাম্যকে টেনে ছিড়ে ছারখার করে দিয়েছে lএরা স্নায়ুতন্ত্রের উপর সরাসরি প্রভাব রাখেl ক্যান্সারকে একধাপ এগিয়ে দিয়েছে l শুধু যা খুশি স্যানিটাইজার ব্যবহার করলে কি ভয়ংকরভাবে পরিবেশ ধ্বংস করে সেটা আর কয়েকটা বছর গেলে বুঝবl এখন আপাতত আনন্দে থাকিl মূলত প্রভাব পড়বে জলজ বাস্তুতন্ত্রের উপরl
এখন আমাদের প্লাস্টিক কুড়ুনি নেই, রিসাইক্লিং নেই, লেবার নেই, আইন নেই, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে চিন্তা নেই, এম্প্লয়মেন্ট নেই, মিউনিসিপাল সার্ভিস কমেছে, হেলথকেয়ার বাজেট কমেছে, বেড়েছে ভাইরাস, বেড়েছে ব দূষণ বিপদ l

ll বৃক্ষছেদন তো বেড়ে গেল লকডাউনে ll                        না না না l আবারও ভয়ঙ্কর ভুল l প্রথম কথা গত একবছরের সরকারিভাবে কোনো বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হয়নিl গাছ মানুষ লাগায়নি তেমন ভাবে l মানুষ গৃহবন্দিl উল্টোদিকে বৃক্ষছেদন বেড়েছে l লকডাউনে সবাই গৃহবন্দী l তাই অবস্থা বেসামালl এটাই চোরাকারবারীদের মাহেন্দ্রক্ষণl মহাসুযোগ l সরকার- পুলিশ -সাধারণ মানুষ- রক্ষী সবাই ঘরে ঢুকে আছেন l এর মধ্যে যথেচ্ছ বৃক্ষছেদন হয়েছে l রিজার্ভ ফরেস্টে লক্ষ লক্ষ দামি গাছ লোপাট হয়েছেl আগুন লাগানো হয়েছে বড় বড় জঙ্গলেl প্রাণী হত্যা হয়েছে নির্বিবাদেl অভয়ারণ্য সত্যিই চোরাশিকারিদের অভয়ারণ্য হয়েছে l গত একবছরে সাপ কচ্ছপ পাখি চামড়া সবকিছু চোরাচালান বেড়েছে বিস্ময়করভাবে সহস্রগুণl কোথাও কেউ বাধা দেবার নেইl দেখভাল করার লোক নেই l ওরা নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে কাজকারবার চালিয়ে গেছে l পরিবেশ বিপর্যস্ত সে হিসেবে আমরা রাখিনিl নিশ্চিন্তে বেআইনিভাবে জলা বুঝেছেl লকডাউনে ফ্লাট বাড়ির গজিয়ে উঠেছে বেআইনি ভাবে প্রচুর l ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হয়েছে এই সময়ে l ভেড়ি সংখ্যা থেমে ছিলো না l ইটভাটা বালি খাদান এর সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বেড়েছেl ধান জমি দখল করে ফিশারী বেড়েছে l নজরদারি একেবারেই নেইl মানুষের ভোগ কমেনি দখল কমেনি l লোভ কমেনি l জীববৈচিত্র্য বাড়েনি l

গ্রামে গঞ্জের অবস্থা কেমন?
এই লকডাউন এ গ্রামের অবস্থা আরো শোচনীয়! আয় ইনকাম প্রায় নেই l পরিযায়ীরা বাড়ি ফিরেছেন l তারা গ্রামীণ বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছেনl নিম্ন আয়ের মানুষ আবার ডালপালা অরণ্য নিধন করছেনl লাইসেন্সবিহীন কাজকর্ম বাড়ছে l বেআইনি বন্যপ্রাণীর বাজার বেড়েছেl পয়সা নেই -তো খাবার তো চাই! তাই পরিবেশ থেকে খাদ্য সংগ্রহের চাপ বাড়ছেl এক বছরে বৃক্ষচ্ছেদন বেড়েছে প্রতিটা হটস্পটে l গাছ পাতলা হয়ে আসছে এটা স্যাটেলাইট চিত্রে পরিষ্কার l ঈশ্বর!এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার! হঠাৎ করে বেআইনি প্রাণীহত্যা বেড়ে গেছে l সরকারি স্তরে কনজারভেশন উদ্যম কমেছেl আইন প্রয়োগ হয়নিl লোক নেই ইকোট্যুরিজম পার্কে l সাফারি বন্ধl টুরিস্টের টাকা না মেলায় প্রাণীর পেছনে খরচ কমেছে l সাফারি পার্ক সংরক্ষিত আরণ্যে ওদের অবস্থা আরো বেসামাল l আবার এই লকডাউন সময় বিদেশী প্রজাতির অ্যালিয়েন প্রজাতি আমাদের পরিবেশে দাপিয়ে বেড়িয়েছে l আমরা ওদের দমন করার চেষ্টা করিনি l এই সময়ে বিদেশি মাছ গাছ বেড়েছে বেপরোয়াভাবেl কোনার দিকে ঠেলে দিয়েছে আমাদের দেশীয় জীববৈচিত্র্যকে l নিঃশব্দে ধ্বংস করে গেছে আমাদের জীববৈচিত্র্যl

আমাদের আশেপাশের জীবজন্তুদের কি অবস্থা?
যে সমস্ত জীবের মানুষের সাহচর্য লাগতো – কাক কুকুর- এরা খুবই বিপদের মধ্যে আছে l ওয়েস্ট ফুডের পরিমান কমেছেl ওদের খাবারের বড্ড অভাব l ভোগ কমেনি আমাদের l অবৈধ যোগান বেড়েছে l স্বল্প সময়ের দিকে তাকালে উন্নতি বলে মনে হচ্ছিল l দীর্ঘমেয়াদি কথা ভাবলে পরিবেশ পিছিয়ে গেছে বহুগুণ এই দেড় বছরে l

llলেজে গোবরে ll
এক ধরনের দূষণ কমলেও অন্য ধরনের দূষণ বেড়েছেl ন্যানোপ্লাস্টিক পরিবেশে অন্তত তিনশ বছর থাকবেl পরিবেশের আইন নতুন করে লাগু হয়নিl গাছ লাগাইনি,নজরদারি বাড়েনি, চোরাশিকার বেড়েছে,কাজ হারানো মানুষ পরিবেশের উপর অত্যাচার করেছেl ক্ষতি হওয়া অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবার জন্য প্রবল বেগে ঝাঁপিয়ে পড়বে কয়েকদিন পর তার নখ দাঁত বের করে l পোষ্যদের খাদ্যের ভয়ঙ্কর অভাব l রিসাইকেল বন্ধ, অনলাইন কেনাকাটা, ট্রান্সপোর্ট খরচ বেড়েছে l পুনর্নবীকরণ শক্তির ব্যবহার হয়নি,সৌরবিদ্যুৎ বায়ুবিদ্যুৎ জিওথার্মাল শক্তি ব্যবহার করিনি l পরিস্থিতি সেই একই আছে এক বছরে l তাহলে পরিবেশের ভালো কোথা থেকে হবে বলতে পারেন? বরং রাষ্ট্রের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়েছে l বাজেট কমেছেl প্রাত্যহিক জীবনে পরিবর্তন আসেনিl বাড়িতে আছি কিন্তু আমাদের মন থেকে যে বর্বরতাকে তুলে ফেলতে পারিনিl পরিবেশকে ভেতর থেকে ভালবাসতে পারিনি l তাই দীর্ঘ মেয়াদী হিসাব করলে তার কূল-কিনারা পাবোনাl ইকোনোমি ভালো না হলে এনভারমেন্ট ভালো থাকবে কিভাবেl গ্লোবাল ইকোনমিক 3.9 শতাংশ কমেছেl জল ব্যবহার বেড়েছে l চিকিৎসা বর্জ্য বেড়েছে বহুগুণl বাড়িতে বসে এসি এর ব্যবহার এবং ক্লোরোফ্লোরো কার্বন নির্গমন বাড়িয়েছি আমরা সবাই যদিও অফিস বন্ধ l এক জায়গার বদলে পাঁচ জায়গায় এসি চলেছে l
এ তো গেল পরিবেশের এখ পিঠ! অন্য পিঠে দৃশ্যদূষণ বেড়েছে ভোট কেন্দ্র করেl দেওয়াল লিখন হোডিং ফ্লেক্স প্লাস্টিক সবই আছে l কেউ ভাবিনি l সব ই পরিবেশে আছে l মানসিক নির্যাতন দূষণ পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে l

তাহলে কি সব দিক থেকে নিরাশা চিত্র?
সবাই বলেছেন গঙ্গার জল ভালো হয়েছে l কিন্তু এটাও তো ঠিক- গঙ্গায় সারি সারি মৃতদেহ ভেসেছেl সচেতনতা বাড়লে এটা ঘটতো না l ওখানেই অভাব lগঙ্গা ভালো থাকে কি করে?নদী বেঁধে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে এক বছরে! ডলফিন বাচ্চা দিয়েছিলো l সেই বাচ্চার শরীর মানুষ ছিঁড়ে ফেলেছ তার ভিডিও তুলে বাজারে ভাইরাল করেছে l আইন চোখ বন্ধ করে আছেl মানুষের চেতনা হয়নিl বাধ্য হয়ে বাড়িতে আছে l প্রকৃতিকে ভালবাসেনি l বাধ্য হয়ে বন্দি l নিজেদের লোভকে বন্দি না করতে না পারলে মুক্তি নেইl মানুষ নিজে গৃহবন্দি হলে পরিবেশ ভালো থাকে নাl কোনটা প্রয়োজন আর কোনটা লাক্সারি এটা না বুঝলে সমাধান নেই l তাই ওপরের ভালোর আড়ালে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির তালিকা ছোট নয় কিন্তু l লোভের গলায় বেড়ি পারানো আশু প্রয়োজন বৈকি!

RELATED ARTICLES

Most Popular